** বিশ্বজিৎ দাস – একজন হতভাগ্য ফুটবলারের নাম ** সালটা সম্ভবতঃ ১৯৭০ কিংবা ১৯৭১। বিবেকানন্দ পার্কে খেলা চলছে কলকাতা স্কুল লীগে তীর্থপতি ও রাজেন্দ্রনাথ বিদ্যাভবনের মধ্যে। তীর্থপতি’র একের পর এক আক্রমণ প্রতিহত করে দিচ্ছিল রাজেন্দ্রনাথের বছর ১৫-১৬র এক ছিপছিপে চেহারার গোলরক্ষক। কিশোরটির শারীরিক সক্ষমতা ও বুদ্ধিদীপ্ত খেলায় তখন মুগ্ধ মাঠে উপস্থিত দর্শকেরা। এমন সময় বিপক্ষ ফরোয়ার্ডের পা থেকে বল কাড়তে গিয়ে গুরুতরভাবে জখম হয় কিশোরটি। ফেটে যায় তার ঠোঁট, ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোতে থাকে। তারপরেও একহাতে ঝুলে পড়া ঠোঁট চেপে অদম্য মনোবল নিয়ে খেলে যায় কিশোরটি। অবশেষে খেলার অন্তিম লগ্নে তার দল একটি গোল করে জিতে যায়। কিশোরটির নাম বিশ্বজিৎ দাস। সেদিন থেকেই বিশ্বজিৎ কলকাতা ময়দানের জহুরীদের নজরে এসে পড়ে। * ১৯৭৩-৭৬ : উত্থানের কয়েকটি বছর : এরপর ১৯৭৩ সালে কলকাতা ময়দানে টালিগঞ্জ অগ্রগামীর হয়ে অসাধারণ খেললেন বিশ্বজিৎ। টালিগঞ্জই বিশ্বজিৎ এর প্রথম ক্লাব কিনা তা আমার সঠিকভাবে জানা নেই। এরপর ১৯৭৪ এ একরাশ স্বপ্ন চোখে নিয়ে বিশ্বজিৎ যোগ দেন ইষ্টবেঙ্গলে। প্রথম বছরেই বিশ্বজিৎ দলে নিজের জায়গা করে নিলেন। ১৯৭৫-৭৬ও কাটে ইষ্টবেঙ্গলে। ‘৭৫- এ তরুণ বসু ইষ্টবেঙ্গলে যোগ দিলে বিশ্বজিৎ হয়ে যান দ্বিতীয় গোলরক্ষক। ‘৭৬-এ কিন্তু মোহনবাগানের বিরুদ্ধে শীল্ড ফাইনালে গোলরক্ষার দায়িত্বে ছিলেন বিশ্বজিৎ। ‘৭৪ ও ‘৭৬ এই দুই বছর বাংলার হয়ে সন্তোষ ট্রফিতে প্রতিনিধিত্ব করেন। ‘৭৬এ বাংলার হয়ে নিয়মিত খেলার পর এক বেসরকারি ভারতীয় দলের হয়ে খেলেছিলেন ‘৭৭ সালের গোড়ার দিকে ভারত সফরে আসা একটি রাশিয়ান ক্লাব দল ‘সিনিক জারোস্লাভ’ এর বিরুদ্ধে। * ১৯৭৫ – ফুটবল জীবনের প্রথম বাধা : দারুণভাবে উঠে আসার মুখে বিশ্বজিৎ প্রথম বাধা পান ‘৭৫ সালের জুনিয়র ইন্ডিয়া ক্যাম্পে। পাতিয়ালার ক্যাম্পের জুনিয়র ইন্ডিয়া টীমের সঙ্গে বোম্বাইয়ে সিনিয়র ইন্ডিয়া টীমের একটি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ম্যাচে ইন্দার সিং-এর একটি সেন্টারে হেড নেওয়ার জন্য আকবর লাফিয়ে উঠলে তাকে বাধা দিতে লাফিয়ে ওঠেন বিশ্বজিৎও এবং হাঁটুতে চোট পান। হাঁটুর সেই আঘাত পরবর্তী কালে মাঝে মাঝেই তার ফুটবল জীবনকে ব্যাহত করে। * ১৯৭৭ – ফুটবল জীবনের একটি অন্ধকারময় বছর : ‘৭৬-এর শেষে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল যে সাসপেন্ডেড তরুণ বসু ইষ্টবেঙ্গল ছাড়ছেন। অপরদিকে ‘পাখতাকোর ম্যাচ’ এ দুর্দান্ত খেলা ভাস্করের ওপর তখন কোচ অমল দত্ত বেশি ভরসা রাখতে শুরু করেছেন। এদিকে মোহনবাগান গোলরক্ষক প্রশান্ত মিত্র অবসর ঘোষণা করায় মোহনবাগানে নিশ্চিত জায়গা পাওয়ার আশায় তিনি ঐ দলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পরবর্তীকালে তার এই সিদ্ধান্তের জন্য তিনি অনুতাপ করেছিলেন। কারণ ডাঃ নৃপেন দাস ব্যক্তিগত ভাবে বিশ্বজিৎকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। কিন্তু বিশ্বজিৎ তাঁকে কিছু না জানিয়েই দল ছেড়েছিলেন। প্রথম থেকেই মোহনবাগানে ছন্দে ছিলেন না বিশ্বজিৎ। মরশুমের শুরুতে প্রথম ফেডারেশন কাপ টূর্ণামেন্টে পাঁচটি গোল খেলেন তিনি। তারপর লীগের সেই অভিশপ্ত বড় ম্যাচ। প্রায় গোটা দল ব্যর্থ হলেও সমস্ত দোষ এসে পড়ে তার ওপর। পরবর্তী সময়ে বিশ্বজিৎ বলেছিলেন যে সমরেশ চৌধুরীর ফ্রি কিকের সময় এমনভাবে প্লেয়াররা গার্ড দিয়েছিলেন যে তিনি বলটিকে দেখতেই পান নি। এই ম্যাচের পরই শুরু হল তার ফুটবল জীবনের বিভীষিকাময় অধ্যায়। পরের ম্যাচে হাওড়া ইউনিয়নের সঙ্গে মাঠে নামার আগেই সভ্য গ্যালারী থেকে ছোড়া ইটের আঘাতে তার জার্সি রক্তাক্ত হয়ে ওঠে। সেই সময় মাঠে নামতে না চাওয়া বিশ্বজিৎকে বুঝিয়ে মাঠে নামান সুভাষ ভৌমিক। কিন্তু খেলার পরে তার উদ্দেশ্যে উড়ে আসতে লাগলো ঝাঁকে ঝাঁকে ইট আর কাঠের টুকরো। শৈলেন মান্না ছাতা খুলে তাকে বাঁচিয়ে টেন্টে নিয়ে আসেন। পরের ম্যাচে সালকিয়ার সঙ্গে দ্বিতীয়ার্ধে সবুজ গ্যালারির সামনে গোলরক্ষা করার সময় আবার উড়ে আসে ইটের টুকরো। ভেঙে পড়া বিশ্বজিৎ ভুল করে একটা ইটের টুকরো পাল্টা ছুঁড়ে দেন গ্যালারিতে। অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠলো গ্যালারি। তারা বিশ্বজিৎকে আর কিছুতেই খেলতে দেবে না। কোচ পি কে বাইরে থেকে বিশ্বজিৎকে উঠে আসতে বলেন, নয়তো ম্যাচ বন্ধ হয়ে গেলে দু পয়েন্ট কাটা যাবে। প্রসূন ও সুভাষ প্রতিবাদ করে বিশ্বজিৎ-এর পাশে দাঁড়ান। বিশ্বজিৎ দর্শকদের কাছে ক্ষমা চাইলে তারা তাকে খেলতে দেয়। মোহনবাগান জিতেই মাঠ ছাড়ে। ঘুষ খাওয়ার অপবাদে অভিযুক্ত ২২ বছরের বিশ্বজিৎ রাস্তা-ঘাটে ও ময়দানে সর্বত্র লাঞ্ছনার যন্ত্রণা সহ্য করতে থাকেন। এমনকি কসমস ম্যাচের দিন সেই উৎসবমুখর পরিবেশেও যখন বিশ্বজিৎ দ্বিতীয়ার্ধে মাঠে নামেন তখনও তার দিকে ছুটে আসে ইটের টুকরো। বরদলুই সেমিফাইনাল থেকেই শিবাজী প্রথম দলে জায়গা করে নেন। ডুরান্ডে একটিও ম্যাচে তিনি সুযোগ পেলেন না। এরপর প্র্যাকটিসে হাঁটুতে চোট পাওয়ায় রোভার্স খেলতে আর যাওয়া হয়নি। মোহনবাগান তার প্রতি আর আগ্রহ দেখায়নি। * ১৯৭৮ – ইষ্টবেঙ্গলে প্রত্যাবর্তন : ‘৭৮এ ফিরে আসেন আবার ইষ্টবেঙ্গলে। কিন্তু পুরনো হাঁটুর চোটে ভুগতে শুরু করেন। দ্বিতীয়বার কার্টিলেজ অপারেশন করাতে হল। সুস্থ হওয়ার জন্য প্রচন্ড পরিশ্রম শুরু করলেন। কিন্তু তখন ভাস্কর টপ ফর্মে। কেবলমাত্র বিশ্বজিৎ নন, সে বছর আবার ইষ্টবেঙ্গলে ফিরে আসা তরুণ বসুকেও প্রায় সারা মরশুম মাঠের বাইরে কাটাতে হয়। * ‘৭৯-৮০ – নিজেকে ফিরে পাওয়ার বছর : ‘৭৯তে যোগ দিলেন জর্জ টেলিগ্রাফে এবং সেখানে বেশ ভালোই খেললেন। এরপর ‘৮০ সালে রাজস্থানে যোগ দিয়ে আবার নিজের দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাস পুরোপুরি ফিরে পান। কলকাতা লীগ সেবছর অসমাপ্ত ভাবে শেষ হওয়ায় সেভাবে প্রচারে এলোনা লীগে তার পারফরমেন্স। সিকিম গোল্ড কাপেও তিনি রাজস্থানের হয়ে অসাধারণ খেলেন ও প্রতিযোগিতার সেরা গোলরক্ষক হন। * ১৯৮১ – পুনরায় ইষ্টবেঙ্গলে প্রত্যাবর্তন : দুর্দান্তভাবেই ফিরে এলেন বিশ্বজিৎ। ইষ্টবেঙ্গলের যোগ দিয়েই প্রথম দলে জায়গা করে নিলেন। ফেডারেশন কাপের দ্বিতীয় সেমিফাইনালে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে অনবদ্য খেললেন। লীগেও তার খেলা দর্শকদের মন জয় করে। সে বছর সন্তোষ ট্রফিতে বাংলা দলেও আবার জায়গা করে নিলেন তিনি। * ১৯৮২ – পুনরায় অপবাদে বিদ্ধ তার ফুটবল জীবন : ‘৮২র শুরুতে ফেডারেশন কাপে খেলতে গিয়ে আবার বিশ্বজিৎকে মিথ্যা অপবাদের স্বীকার হতে হল। কোয়ার্টার ফাইনাল গ্রুপ লীগের প্রথম ম্যাচে সালগাওকারের কাছে প্রথম ম্যাচে দু গোলে হারলো ইষ্টবেঙ্গল। সে বছর বিশ্বজিৎ-এর অধিনায়ক হওয়ার কথা থাকলেও ক্লাব অফিসিয়ালরা ফেডারেশন কাপে অধিনায়কত্ব করার জন্য সুধীর কর্মকারকে বেছে নেন। ম্যাচের শেষে রটিয়ে দেওয়া হল ক্যাপ্টেনশিপ না পেয়ে ক্ষুব্ধ বিশ্বজিৎ ইচ্ছে করে গোল ছেড়ে দিয়েছেন। কোচ অমল দত্তও কথাবার্তা ও হাবেভাবে এই রটনাকে সমর্থন জানান।(পত্রিকায় সেই সময়ে প্রকাশিত এই সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদনের ছবি এই post এর সঙ্গে তুলে দিলাম) ধীরে ধীরে বিশ্বজিৎ প্রথম দল থেকে বাদ পড়ে গেলেন। দারুণভাবে উঠে এসে তার জায়গা দখল করে নিলেন নবাগত গোলরক্ষক তাপস চক্রবর্তী। * ১৯৮৩ – আবার মোহনবাগান : অনেক আশা নিয়ে আবার ‘৮৩তে সই করলেন মোহনবাগানে। ফিজিক্যালি ফিট থাকা সত্ত্বেও কোচ অরুন ঘোষ সারা বছরে তাকে একটির বেশি ম্যাচে সুযোগ দিলেন না। বিশ্বজিৎ পরে অভিযোগ করে বলেছিলেন যে অরুন ঘোষ নাকি অনেকের কাছে বলেছিলেন মোহনবাগান সমর্থকরা বিশ্বজিৎকে চায় না। যদিও নিয়মিত প্র্যাকটিস করে যাওয়া এবং খেলার দিন মাঠে থাকা বিশ্বজিৎ-এর তেমন কিছু মনে হয়নি। পরের দিকে কোচ নাকি তার সঙ্গে ভালো ভাবে কথাও বলতেন না। * ‘৮৪ – ফুটবল জীবনের যবনিকা পতনের বছর : মহমেডান ‘৮৪তে তাকে চাইলেও তিনি সই করলেন বোম্বাইয়ের মফতলালে। কিন্তু আবার চোটের জন্য তিনি কলকাতায় চিকিৎসা করাতে আসেন। মফতলাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এ বিষয়ে মতবিরোধ ঘটে এবং তারা বিশ্বজিৎকে বরখাস্ত করে। (এই সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদনের ছবিও post এর সঙ্গে তুলে দিলাম) পরিসমাপ্তি ঘটলো একটি ভাগ্যবিড়ম্বিত ফুটবল জীবনের। বড় ক্লাবের ব্যর্থ ফুটবলারদের দীর্ঘ তালিকাতে বিশ্বজিৎ-এর নাম উচ্চারিত হলেও ময়দানের সঙ্গে যুক্ত অনেকেই মনে করেন যে প্রতিভার দিক দিয়ে ‘৭০ দশকের সেরা তিন গোলরক্ষক হলেন তরুণ বসু, ভাস্কর গাঙ্গুলি ও বিশ্বজিৎ দাস। এমনকি অনেকের এটাও ধারণা যে ‘৭৭এ তিনি ইষ্টবেঙ্গল না ছাড়লে ভাস্কর এত দ্রুত উঠে আসতে পারতেন না। বিশ্বজিৎ থাকতেন কালিঘাট এলাকায় চন্দ্রমন্ডল লেনে। এখন তিনি কেমন আছেন বা ফুটবলের সঙ্গে কতটা যুক্ত আছেন তার কোনো খবর আমার কাছে নেই।