ঝাড়গ্রাম-বেলপাহাড়ী (পর্ব-১)সন্দীপ পাল আন্তর্জাতিক ও জাতীয় স্তরে সুযোগ না থাকায় থেকে নিজেকে রীতিমতো রাজ্য-জেলা স্তরে নামিয়ে আনতে হয়েছে। তারপর হঠাৎ একদিন মনে পড়লো বিশ্বকবির এই বিখ্যাত পংক্তিটি – “দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া ঘর হতে দুই পা ফেলিয়া” – যা বোধহয় মানুষ বেশি করে অনুধাবন করেছে অতিমারীর চোখ রাঙানিতে এবং আমিও তার বিন্দুমাত্র ব্যতিক্রম নই। সত্যিই তো, বাংলার বুকেই যে এত সুন্দর সুন্দর জায়গা আছে না দেখলে বিশ্বাসই করতাম না! তাই ঘরে বসে একটা power-packed প্ল্যান বানিয়ে ফেলি। শিরোনামের পাশে পর্ব দেখেই আশা করি বুঝতে পারছেন কম সময়ে বেশ বড়সড় প্ল্যান। সত্যিই তাই, আমিও এর আগে কোনোদিন একদিনের ভ্রমণ অভিজ্ঞতাকে একাধিক পর্বে ভাগ করিনি, কিন্তু এবারে করতে বাধ্য হয়েছি। ভেবেই রেখেছিলাম, অতিমারীর কারণে কোথাও থাকবনা। তাই যা ঘোরাঘুরি হবে চার-চাকায়। এই সময় ঘোরার একটা সুবিধা হচ্ছে পর্যটনস্থল গুলোতে পর্যটকদের অনুপস্থিতি বা গুটিকয়েক ভ্রমণপ্রেমীর আনাগোনা। ঝাড়গ্রাম-বেলপাহাড়ির দিকটা আমার ক্ষেত্রে এর আগে “দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া”, তাই মূলত ওই জায়গার ওপর নির্ভর করে আমার প্ল্যান বানানো। ট্রিপ প্ল্যান: বাড়ী থেকে যাত্রা শুরু করে কোলাঘাট-খড়্গপুর হয়ে লোধাশুলি থেকে ডানদিকের রাস্তা ধরে সোজা ঝাড়গ্রাম। সেখান থেকে যথাক্রমে নিম্নিলিখিত জায়গাগুলি পরপর যাবো ঠিক করলাম মূলত গুগল মাপের সাহায্য নিয়ে:১) চিল্কিগড় রাজবাড়ী ২) কনকদূর্গার মন্দির ৩) বেলপাহাড়ী ৪) ঢাঙিকুসুম ৫) ঘাগড়া জলপ্রপাত ৬) খাণ্ডারিনী জলাধার ৭) ঝিলিমিলির তালবেড়িয়া জলাধার তারপর বিষ্ণুপুর-আরামবাগের রাস্তা ধরে বাড়ী ফিরবো। সবমিলিয়ে ৫০০ কিলোমিটারের কিছু বেশি পথ – একটা round trip বলা যেতে পারে।জুলাই মাসের মাঝামাঝি ভোর ৫:৪৫-এ “ঘর হতে দুই পা ফেলিয়া” আমার যাত্রা শুরু। ভেবেছিলাম ৫টায় রওনা দেব, কিন্তু বাঙালীর সময় বুঝতেই পারছেন। সারাদিনের এরকম লম্বা ভ্রমণের একটা ধকল তো আছে বটেই, সেকথা মাথায় রেখে পরিবারের কাউকে সাথে নিইনি। তাই ভ্রমণসঙ্গী বলতে শুধুমাত্র আমার রথের সারথি – রাজা। সকাল পৌনে সাতটা নাগাদ উলুবেড়িয়ার কাছে আজাদ হিন্দ ধাবায় দাঁড়ালাম চায়ের জন্য, কিন্তু রেডি নেই – মিনিট ১৫ সময় লাগবে। আজ আমার কাছে সময়ের দাম খুব বেশি। তাই আরও এগিয়ে কোলাঘাটের কাছে নিউ তাঁরামা হোটেলে চা বিরতি দিয়ে আবার শুরু পথ চলা। এর মধ্যে আবার ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হল। গাড়ী এগিয়ে চললো ডেবরা-খড়্গপুর হয়ে সোজা লোধাশুলি। সবমিলিয়ে তিনটে টোল চার্জ দিতে হবে – মোট ২৪৫ টাকা (ভিডিওতে বিস্তারিত পেয়ে যাবেন)। আপনি কলকাতা থেকে এলেও এই তিনটি টোল পাবেন লোধাশুলি পর্যন্ত। লোধাশুলি থেকে ডানদিকে ঝাড়গ্রাম যাওয়ার রাস্তা। আকাশের মুখ ভার। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিটা যেন আমাদের সাথেই এগোচ্ছে। খানিক পরেই শুরু হল ঘন সবুজ বনবীথি। এই রাস্তা ধরে বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর একজায়গায় রাস্তা দুভাগ হয়ে গেছে – একটা রাস্তা সোজা চলে গেছে ঝাড়গ্রাম শহরে, আর বাঁদিকের রাস্তাটি (ঝাড়গ্রাম-জামবনি রোড) বেলপাহাড়ীর দিকে। সেই মোড়ে পুলিশি টহল, গাড়ি থামাতে হল। আগেই খবরে শুনেছিলাম ঝাড়গ্রাম ‘রেড-জোন’ তকমা পেয়েছে। একজন অফিসার গোছের পুলিশ জিজ্ঞেস করলো কোথায় যাবেন। ‘বেলপাহাড়ী’ বলতেই ছেড়ে দিল, কিন্তু যারা ঝাড়গ্রাম শহরে ঢুকতে চাইছে তাদের ফিরিয়ে দিচ্ছে। প্রথমে আমরা যাব চিল্কিগড় রাজবাড়ী – আমার বাড়ী থেকে যার দূরত্ব পুরোপুরি ২০০ কিমি, তবে এই একটু আগে যে মোড়ে পুলিশ আমায় জিজ্ঞাসাবাদ করলো সেখান থেকে এই রাজবাড়ীর দূরত্ব মাত্র ১৩ কিমি। রাজবাড়ীর ১ কিমি আগে রাস্তার ডানদিকে পরবে কনকদূর্গা মন্দিরটি। তবে আমরা রাজবাড়ী দেখে এসে তারপর মন্দির দর্শন করি। ডুলুং নদী পেরিয়ে রাজবাড়ীর রাস্তা। বর্ষায় নদীতে বেশ ভালোই জল (ভিডিওতে দেখুন – চোখ জুড়িয়ে যাবে)। রাস্তার সোজাসুজি রাজবাড়ীর সিংহদুয়ার। প্রকান্ড মাঠের এক কোনে রাজবাড়ীটি, অন্য প্রান্তে ভগ্নপ্রায় একটি লম্বাটে মন্দির। আরেকদিকে রাসমঞ্চ আদলে তৈরী আরেকটি রাধাকৃষ্ণ মন্দির। কিছু ভগ্নপ্রায় অংশও চোখে পড়লো। এবার ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো। তাড়াতাড়ি গাড়ীতে উঠে রাজাকে বললাম, “কনকদূর্গা মন্দির চল”।৩-৪ মিনিটে পৌঁছে গেলাম। মন্দির ঢোকার রাস্তাটি সরু হলেও ভেতরে গাড়ী পার্কিংয়ের প্রশস্ত জায়গা আছে। পার্কিং চার্জ – ৫০ টাকা। বৃষ্টি তখনও পড়ছে। তাই গাড়িতে বসে বাড়ী থেকে আনা খাবার দিয়ে ব্রেকফাস্ট করে নিলাম। বৃষ্টি থামলে গাড়ী থেকে নেমে মাথাপিছু ৫ টাকা টিকিট কাটলাম। কয়েক মিনিটের হাঁটাপথ। তবে চারিদিকে ঘন গাছপালায় ঘেরা পথটি দিয়ে হাঁটতে বেশ লাগে। এখানে নাকি প্রায় ৪০০রও বেশি ওষধি গাছপালা আছে।চিল্কিগড় থেকে বেলপাহাড়ী প্রায় ২৭ কিমি পথ, রাস্তায় বেশ মসৃন। পথে কিছু কিছু জায়গার প্রাকৃতিক শোভা আপনাকে গাড়ী থামাতে বাধ্য করবেই। বেলা ১২টা নাগাদ বেলপাহাড়ী বাজার পৌঁছলাম। এখানে ‘কাঁচালঙ্কা’ নামে একটি খাবার হোটেল আছে – গুগল রিভিউ দেখে নিয়েছিলাম। সেখানে বলে গেলাম, ঢাঙিকুসুম দেখে এসে আমরা দুজন দুপুরে খাবো। বেলপাহাড়ী থেকে ঢাঙিকুসুম ১৫ কিমি পথ। যাওয়ার রাস্তটি বেশ সরু তবে প্রকৃতির কাছাকাছি নিরিবিলিতে এসব রাস্তায় ড্রাইভ করার মজাই আলাদা। এই রাস্তার শেষের দিকটা কিন্তু বেশ উঁচুনিচু অনেকটাই পাহাড়ি রাস্তার মতো, তবে গাড়ি চালাতে অসুবিধা হবেনা। ঢাঙিকুসুম পৌঁছোবার খানিক আগে থেকেই শুরু হলো তুমুল বৃষ্টি। ১২:৩০ নাগাদ পৌঁছলাম, তবে গাড়ী থেকে নামতে পারলামনা। অগত্যা গাড়িতে বসেই রাস্তার পাশে সদ্য পোতা ধানের ক্ষেত, গ্রাম্যজীবন ও প্রকৃতি চাক্ষুস করতে হল। এখানে ঢাঙিকুসুম ও ডুঙরি জলপ্রপাত আছে, আপনারা এলে দেখে নিতে পারেন।দুপুর দেড়টা নাগাদ আবার বেলপাহাড়ী বাজারে ফিরে এলাম। ‘কাঁচালঙ্কা’য় আমাদের দুপুরের খাবার রেডি। নিরামিষ থালি (ভিডিওতে দেখুন) ১০০ টাকা, এক্সট্রা ভাত, ডাল, তরকারি যত ইচ্ছা নিতে পারেন। চিকেন ১২০ টাকা প্লেট (৪ পিস্)। হোটেলটি ছোট হলেও খাবারের স্বাদ ছিল অতুলনীয়। ভিডিও লিঙ্ক: https://youtu.be/I6Wf8DqZ8GE(ক্রমশ)খরচ: আমার গাড়ী মোটামুটি গড়ে প্রতি লিটারে ১৬ কিমি সার্ভিস দেয়। সেটা ধরে হিসেবে করলে ৫৩০ কিমিতে পেট্রল লেগেছে ৩৩ লিটার মতো, যাকে ১০২ টাকা (প্রতি লিটার পেট্রল মূল্য) দিয়ে গুন করলে দাড়ায় ৩,৩৭৮ টাকা। দুজনের মধ্যাহ্নভোজে খরচ হয়েছে ৩৩৫ টাকা। আর কনকদূর্গা মন্দিরে গাড়ী পার্কিং ফী ৫০ টাকা ও প্রবেশমূল্য মাথাপিছু ৫ টাকা। ব্যাস এটুকুই সর্বসাকুল্যে খরচ।পুনশ্চ: যারা কোথাও না থেকে দিনের-দিন কাছে-পিঠে ঘুরে আসতে চান, শুধুমাত্র তাদের সুবিধার জন্যই এই তথ্যবহুল পোস্ট। পছন্দ না হলে, পোস্টটি উপেক্ষা করে এগিয়ে যান, অবান্তর মন্তব্য করে নিজের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের পরিচয় দেবেন না। যেহেতু আমি গাড়ীতেই গোটা ট্রিপটা করেছি, তাই ট্রেনে কিভাবে জায়গাগুলিতে পৌঁছতে হয়, নিকটতম স্টেশন, থাকার জায়গার সন্ধান – এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর আমার জানা নেই।