অযোধ্যা পাহাড়ের ওপর এক ভয়ঙ্কর বিপদ নেমে এসেছে আর এর পেছনে রয়েছে বিদেশি কর্পোরেট ও রাষ্ট্রের চক্রান্ত। অযোধ্যা পাহাড়ের ওপর চারটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের দ্বিতীয় প্রকল্প ঠুড়গা পাম্প স্টোরেজ প্রজেক্ট এর কাজ শুরু করছে West Bengal State Electricity Distribution Company Limited (WBSEDCL); যার লক্ষ্য হচ্ছে ১০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা। ৬৯২২ কোটি মূল্যের এই প্রকল্পের সাফল্যের জন্য রীতিমতো কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে কর্পোরেটরা। বিশ্বায়নের এই রমরমার সুযোগে বনভূমি লুঠে সামিল হয়েছে বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও। সরকারি হিসেব জানাচ্ছে ঠুড়গা প্রকল্পের জন্য ২৯২ হেক্টর জমি নেওয়া হবে যার মধ্যে ২৩৪ হেক্টর বনভূমি। যদিও সরকারি হিসেব আর পরিবেশবিদ ও অযোধ্যা পাহাড়ের আদিবাসীদের হিসেব দুটো অন্যরকম কথা বলছে। সরকার যেখানে বলছে মাত্র ছয় হাজারের মতো গাছ কাটা হবে, সেখানে পরিবেশকর্মীদের মতে কাটা হওয়া গাছের পরিমাণ ৩ লাখ। স্থানীয় মানুষেরা ভয় পাচ্ছেন এই প্রকল্প অযোধ্যা পাহাড়ের বাস্তুতন্ত্রকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেবে। ওই অঞ্চলের যে বিস্তীর্ণ বনভূমি বিলুপ্ত হবে তার সাথে সাথে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ওই বনভূমিতে বসবাসকারী বিভিন্ন প্রাণী ও বিরল প্রজাতির গাছ, ভেষজ উদ্ভিদ।ওখানকার আদিবাসীদের কাছে অযোধ্যা [ আয়োদেয়া; মানে ‘মায়ের পিঠ’] পাহাড়ের জঙ্গল জীবনধারণের সবথেকে বড় উৎস। জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করা বিভিন্ন রকমের ফল, ভেষজ উদ্ভিদ, খাদ্যদ্রব্য ও কাঠ ইত্যাদি ওখানকার আদিবাসীদের বেঁচে থাকার ভরসা। তাই ওই জঙ্গলের ওপর একমাত্র অধিকার রয়েছে ওখানকার আদিবাসীদের। অযোধ্যা পাহাড়ের ওই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে 39 রকমের স্তন্যপায়ী, 9 রকমের উভচর ও 27 রকমের মাছ পাওয়া যায় যা এই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের ফলে বিলুপ্তির পথে চলে আসবে। স্বাভাবিকভাবেই কর্পোরেটের থাবা গিয়ে পড়বে ওখানকার আদিবাসীদের গ্রামগুলোতে, আর উন্নয়নের নামে আদিবাসীদের উচ্ছেদ করার এই ইতিহাস ভারত রাষ্ট্রের জন্য নতুন জিনিস নয়।এর আগেও 2007 সালে প্রথম জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বসে অযোধ্যা পাহাড়ে। ৯০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন এই প্রকল্পের সময় তৎকালীন সিপিআইএম সরকার প্রতিশ্রুতির হাজার বুলি আওড়ে ছিল। স্থানীয় আদিবাসীদের স্থায়ী চাকরি-কর্মসংস্থান, 5 কিঃমিঃ এর মধ্যে অবস্থিত সমস্ত গ্রামেই বিনামূল্যে বিদ্যুৎ সরবরাহের মত বিভিন্ন ভুয়ো প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। কিছু সংখ্যক মানুষকে প্রজেক্ট চলাকালীন অস্থায়ী কাজ দিলেও পরে সেই কাজগুলো আর থাকেনি। উন্নয়নের নামে শুধুই আদিবাসী উচ্ছেদ আর জমি দখল হয়েছিল। বর্তমানে রাজ্যের স্বৈরাচারী দক্ষিণপন্থী সরকার তাদেরই পথ অনুসরণ করে চলেছে। বনভূমি সংক্রান্ত বিভিন্ন আইনের ভুল ব্যাখ্যা ও ব্যবহারের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে বিভিন্ন সরকারি কাগজে সাইন জোগাড় করার ক্রমাগত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে রাষ্ট্রীয় আমলারা। অনেক ক্ষেত্রে তারা সফল হয়ে গেছে। এদিকে বনাধিকার আইন ২০০৬ কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রাষ্ট্রের এই যে চালাকি তার বিরুদ্ধে স্থানীয় আদিবাসী ও পরিবেশকর্মীদের সংগঠন আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন অনেক আগেই। কিন্তু এই আধা-সামন্ততান্ত্রিক আধা-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের ন্যায়ব্যবস্থাও কর্পোরেটের অধীন।শুধুমাত্র অযোধ্যা পাহাড় নয়, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বনভূমি ও সেখানকার আদিবাসী মানুষদের ওপর প্রতিদিন প্রতি নিয়ত কর্পোরেটের জুলুম নেমে আসছে। সেটা মধ্যপ্রদেশে হীরের খনির জন্য 12 লক্ষ গাছ কাটা হোক বা হরিয়ানার আরাবল্লী পর্বতের আদিবাসী উচ্ছেদের জন্য ফ্যাসিস্ট বিজেপি সরকারের বুলডোজার চালানোর ঘটনাই হোক; রাষ্ট্র তার আসল চরিত্র দেখাচ্ছে বারবার। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে আদিবাসীদের অধিকার এর জন্য লড়াই করা মানবাধিকারকর্মী ও বিপ্লবীদের মিথ্যা অভিযোগে গ্রেফতার করে UAPA দিয়ে আটক করে রাখছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। কিছুদিন আগে সেই আইনের গ্রেফতার হওয়া আদিবাসীদের অধিকার আন্দোলনের কর্মী স্ট্যান স্বামীর রাষ্ট্রীয় খুন এটাই প্রমাণ করে যে সরকার আদিবাসীদের জন্য ওঠা প্রতিটা কণ্ঠস্বরকে শেষ করতে চায়। ইতিমধ্যে গত বছর কেন্দ্রীয় সরকার জনবিরোধী EIA 2020 আইন এনেছে, যেটা ভারতের বিস্তীর্ণ পর্বত মালভূমি ওই জঙ্গলের ওপর সম্পূর্ণ ছাড়পত্র দিয়ে দিচ্ছে পুঁজিবাদী কর্পোরেটদের। পোস্ট ফ্যাক্টো ক্লিয়ারেন্স থেকে শুরু করে বিভিন্ন রকমের ফাঁকফোকর এর মাধ্যমে বনভূমির লুন্ঠনকে আইনত সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে।2016 সালের একটা রিপোর্ট বলছে গত 30 বছরে 14 হাজার স্কয়ার কিলোমিটার বনভূমি বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রকল্পের জন্য ধ্বংস হয়েছে। National Forest Policy 1952 অনুযায়ী ভারতের 33 শতাংশ অঞ্চল বনভূমি থাকা প্রয়োজন। কিন্তু এই মুহূর্তে সেটা 24.56 শতাংশ (তার মধ্যেও আবার চাষবাসের অংশকেও জল হিসেবে মেশানো হয়েছে)। এই পরিস্থিতিতে যখনই এই সমস্ত তথ্য তুলে ধরা হচ্ছে, সরকার CAMPA এর মাধ্যমে বৃক্ষরোপণ করার অজুহাতে দিচ্ছে। কিন্তু এই compensatory afforestation শুধুমাত্র একটা ভাঁওতা। প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি হওয়া সুসংগঠিত বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস করে বৃক্ষরোপনের নামে আদিবাসীদের চাষবাসের জন্য বেছে নেওয়া জমিকে বলপূর্বক দখল করার একটা অজুহাত মাত্র। লিবারেল পুঁজিবাদের দালাল তথাকথিত পরিবেশপ্রেমীরা এইরকম ভাঁওতায় খুশি হলেও, এই ‘বাগান বানানো’ আদৌ পরিবেশের যে দুর্দশা তার কোন উন্নতি করে না। অন্যদিকে কর্পোরেটের ফান্ডিং পাওয়া বিভিন্ন সংসদীয় দল গুলো অযোধ্যা ইস্যু নিয়ে একদম চুপ। যে সিপিএমের আমলেই এই লূটের কাজ শুরু হয়, তাদের কাছ থেকে এখন কোন প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাবে না সেটা স্বাভাবিক। আদিবাসীদের অধিকারের জন্য লড়াই করা মানুষদের বিরুদ্ধেও একই প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়। বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সরকার যথেচ্ছভাবে আদিবাসীদের উপর দমন চালিয়েছে। কংগ্রেস সরকারের আমলে “মাওবাদী দমন”এর নামে অপারেশন গ্রিন হান্ট চালানো হয়েছে যেখানে আদিবাসীদের গ্রামের সরকারি ভাড়াটে গুন্ডা পাঠিয়ে হত্যা, লুঠ, ধর্ষণের মতো অত্যাচার চালানো হয়। বর্তমান ফ্যাসিস্ট বিজেপি সরকারও তার শাসিত রাজ্য গুলোতে একই ধারা বজায় রেখেছে। আবার কেন্দ্রে এক ধাপ এগিয়ে EIA2020 লাগু করে সেইসব কর্পোরেট-লুটকে আইনগত বৈধতা দিচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গেও সিপিএম সরকারের উন্নয়নের নামে আদিবাসীদের জমি দখল করার বিরুদ্ধে ওঠা কণ্ঠস্বরকে রাষ্ট্রীয় বাহিনী পাঠিয়ে দমানোর চেষ্টা হয়েছে। যথেচ্ছভাবে বিনা প্রমাণে আটক ও রাজ্য প্রথম UAPA দেওয়ার ঘটনায় সিপিএম তাদের জোটসঙ্গী কংগ্রেসের থেকে কোন অংশে কম নয়। এখনো পর্যন্ত বহু রাজনৈতিক বন্দী বিনা বিচারে বিভিন্ন জেলে আটক রয়েছেন। এখনো কেরালায় ছাত্র-ছাত্রী ও অ্যাক্টিভিস্টদের বিভিন্ন ভূয়ো অভিযোগে UAPA দেওয়ার পরম্পরা পালন করছে ওরা। আর রাজ্যে ক্ষমতায় আসা স্বৈরাচারী তৃণমূল কংগ্রেস তো অযোধ্যা পাহাড়ের আদিবাসীদের জমি দখল ও উচ্ছেদের পরিকল্পনার মাধ্যমে আদিবাসীদের বঞ্চনার ইতিহাসকেই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আসলে এই মহান “গণতন্ত্রে” সেটাই হয় যেটা এই সংসদীয় দলগুলোর ওপরওয়ালা পুঁজিপতিরা চায়। তাই তো বারবার MoU,SEZ, EIA বিভিন্ন রূপে বোকা বানানোর প্রক্রিয়া চলে।ব্রাজিলের শ্রমিক নেতা ও পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী Chico Mendes বলেছিলেন “ Enviornmentalism without Class Struggle is just Gardening”। আদিবাসীদের জল-জঙ্গল-জমিন দখল করে,উন্নয়নের নামে তাদের নিজেদের মাটি থেকে উৎখাত করে ও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সস্তার শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ করে যে শোষণের নামিয়ে এনেছে রাষ্ট্র, তার বিরুদ্ধে প্রবল গণআন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন। আজ আমাদের গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য হচ্ছে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে ওঠা পরিবেশ আন্দোলন ও আদিবাসীদের গণসংগ্রামকে সমর্থন জানানো। অযোধ্যা পাহাড়ের আদিবাসীরাও ঠুড়গা প্রকল্পের বিরুদ্ধে গণ আন্দোলনের পথ বেছে নিয়েছে। পাহাড়ের বুক থেকে আওয়াজ উঠছে “প্রজেক্ট নয়, প্রটেক্ট চাই… জলাধার নয়, বনাধার চাই”।ঠুগড়া প্রকল্পের বিরুদ্ধে ও ভারত রাষ্ট্রের ও বিদেশী কর্পোরেটের উপনিবেশিক লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে দিকে দিকে গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলুন।#অযোধ্যাবাঁচাও