সূর্যোদয়ের সাথে ভাগ্যোদয়েরও সন্ধানে উশুলডুংরি // কল্যাণ কুণ্ডু কী ভালবাসেন? সাজানো গোছানো হোটেল বা হোম স্টে সমৃদ্ধ পাহাড়ি জনপদ? যেখানে নাগরিক সভ্যতা সবকিছু পসরা সাজিয়ে বসে আছে আপনার অপেক্ষায়? না কি, কাঁচা সবুজ আর আদিবাসী গ্রাম অধুষ্যিত ডুংরির বন্য অনুভূতি? যেখানে পৃথিবী অকৃত্রিম রূপ নিয়ে এখনও হাতছানি দেয় আপনার ভিতর প্রকৃতিপ্রেমী মানুষটাকে । উশুলডুংরিতে থাকার মত কোন হোটেল বা হোম স্টে পাবেন না । এখনও তেমন কোন বিপনি গড়ে ওঠে নি যেখানে ইচ্ছে করলে গলা ভিজিয়ে নিতে কোল্ড ড্রিংকস বা ডাবের জল পাবেন । টাইগার হিলের মত শীতে জমে যাওয়া ভোরে, আবির থালায় ভরে সোনার গুলাল নিয়ে ফাগুয়ার ফাগ খেলা খেলতে খেলতে সূর্য আসবে না । তাহলে, কীসের টানে আসবেন উশুলডুংরি ? এখানেও সূর্য আসে, এখানকার বন্য সৌন্দর্যের ডালি হাতে নিয়ে ।আবিরের রং গোলাপি অথবা লাল। কুয়াশা বা মেঘ না থাকলে এই রঙের খেলাতেও মোহিত হতেই পারেন। আদিম বন্যতায় মোড়া একফালি ভূখন্ড আপনাকে সূর্যোদয়ের ব্রাহ্ম মুহূর্ত বা সূর্যাস্তের প্রশান্তি উপহার দেবে নিজস্ব স্বকীয়তায়। আর সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বিষয় হল আপনি দুটো মুহূর্তকে পেতে পারেন, তাই অযোধ্যা এলে একবার আপনার সময় অনুযায়ী আসতেই পারেন উশুলডুংরিতে । অযোধ্যা হিলটপের পূর্বদিকে পাহাড়ি রাস্তায় মাত্র ন’ কিলোমিটার। পাহাড়ে পাহাড়ে কোলাকুলি করা মধ্যভাগের উপত্যকা দিয়ে সর্পিল পথ ধরে এদেলবেড়া (শিমূলের সাঁওতালি প্রতিশব্দ এদেল) কালি ঝরনা পার হয়ে যে উঁচু ডুংরির দেখা পাবেন সেটাই উশুলডুংরি । উঁচু-র সাঁওতালি প্রতিশব্দ ‘উশুল’ আর ছোট পাহাড়ের সাঁওতালি প্রতিশব্দ ‘ডুংরি’। তিন দিক পাহাড় দিয়ে ঘেরা, আর এক দিকে পাহাড়ের ঢাল বন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে নেমে গেছে মালভূমীয় আপাত সমতলে। দূরে দক্ষিণপূর্বে দেখতে পাবেন গোর্গাবুরু আবার উত্তরপূর্বে গজাবুরু । উশুলডুংরির উত্তরে শিলিংদা, পূর্বে ছাতারজোড় আর গড়ুর ঝরনা। পশ্চিমে এদেলবেড়া (শিমূলবেড়া) আর দক্ষিণে জনমানবহীন জঙ্গলপূর্ণ কালি ঝরনা মৌজা। প্রকৃতির প্রতিকূলতা কাকে বলে উশুলডুংরিতে বসবাসকারী ছ’টি টোলার আদিবাসী মানুষজনই জানেন। দূর্গম ছিল। আজ থেকে ৩৫/৪০ বৎসর আগেও উশুলডুংরি ছিল অযোধ্যার দূর্গমতম স্থান। প্রকৃতি যত দূর্গমতা দেখিয়েছে, উশুলডুংরি, লাতারডুংরি, তালাডুংরির মানুষজন ততোধিক আপোষহীন হয়ে লড়েছে প্রতিকূলতার বিরূদ্ধে। পাষানের বুকে বুক চিতিয়ে হাজারো সমস্যাকে বুকে নিয়ে কাটিয়ে গেছে অরণ্যজীবন। আজকের দিনেও সমস্যা বিশেষ কিছু লাঘব হয় নি। তবু উশুলডুংরি আছে আপন সত্তায় মগ্ন। বৃষ্টি হলে চাষ আবাদ কিছু হয় নতুবা ভূট্টার চাষ করেই জীবন চলে। ব্যবসা বানিজ্যের মূলধন কোথায়? তাহলে তো আধুনিক বিপননের পসরা সাজানোই থাকত পর্যটকদের জন্য। তবে আজকের দিনে যাতায়াতের দূর্গমতা কিছুটা লাঘব হয়েছে। এখন তিনদিক থেকে আপনি পৌঁচ্ছে যেতে পারেন এই সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের দেশে। রোমাঞ্চের টান যাঁদের বেশী তাঁরা আসুন হিলটপ থেকে ক্ষণে ক্ষণে চড়াই উৎরাই সম্পন্ন জঙ্গুলে পথ ধরে। এই খাদে নেমেছে তো পরক্ষণেই উঠেছে পাহাড়ের মাথায়। পাহাড় ডিঙ্গানোর সাথে সাথে ঘন সবুজের হাতছানি। হরেক কিসিমের হরিয়ালি। যদি বনের ভিতরে পা বাড়ান তাহলে প্রতিটি পদক্ষেপ ফেলতে হবে সাবধানে। দৃশ্যমানতা কমে আসবে বিশ তিরিশ মিটারে। তারপর কী অপেক্ষা করছে সেটাই সাসপেন্স। এঁকে বেঁকে চলা রাস্তায় পার হবেন এদেলবেড়া, একটি সাঁওতালি জনপদ। কালি ঝরনাকে ডান দিকে রেখে পূর্বাভিমুখী যাত্রায় পৌঁচ্ছে যাবেন গন্তব্যে।অবশ্য এখন সিরকাবাদ থেকে হিলটপের দিকে আসা নয়নাভিরাম পাকা রাস্তাটিই পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে উশুলডুংরিতে আসার জন্য। পাকা ও চওড়া রাস্তা । বাঁকা ডহরের অনাবিল সৌন্দর্যকে উপভোগ করে লাহাডাংরা পেরিয়ে ছাতনি গ্রামের কাছে পূর্বদিকের রাস্তা ধরলে বামদিকে শিলিংদাকে রেখে এগিয়ে গেলেই পাবেন উশুলডুংরি।আর একটি পথের সন্ধান দিই। অযোধ্যা পাহাড়ে ওঠার অপ্রচলিত এই পথের সৌন্দর্যও অতুলনীয়। পুরুলিয়া শহর থেকে টাটা যাবার রাস্তায় পড়ে ছোট উরমা। সেখান থেকে ডানদিকে বাঁক নিলেই দৃশ্যপট পাল্টাতে থাকে আচমকা। রেল ক্রসিং পেরোলেই পাহাড় হাতছানি দেয়। অনতিদূরে কেরুয়া গ্রাম অতিক্রম করে এগিয়ে চলুন ঘাটবেড়ার দিকে। দুপাশে সবুজ ধানক্ষেত, মাঝে মাঝে অগভীর জঙ্গল- ছোট ছোট ন্যাড়া টিলা। দূরে উঁকি দেয় গজাবুরু শৃঙ্গ। ঘাটবেড়া থেকে খাড়া সরু রাস্তা হেয়ার পিন বেন্ড নিয়ে উঠে গেছে পাহাড়ে। এরপর কিছুটা এগোতেই দেখতে পাবেন গজাবুরু । অনতিদূরে লুকাইচাটানি, কুলাই ডুংরি। এদেলবেড়া ।ছাতরাজোড় দিয়ে আরো কিছুটা এগিয়ে ডানদিকে বেঁকে রাস্তা হঠাৎ উঠে গেছে একটি টিলার মাথায়। নিশ্চয় আর বলতে হবে না এটা উসুলডুংরি। শুধু সূর্যোদয় বা সূর্যাস্ত নয়, মেঘলা দিনেও উসুলডুংরির রূপ দেখে মুগ্ধ না হয়ে থাকতেই পারবেন না । অতি সম্প্রতি টিলার মাথায় তৈরি হয়েছে একটি চারতলা ওয়াচ টাওয়ার। স্থান নির্বাচন নিয়ে প্রশংসার অবকাশ রাখে না। সেখান থেকে চারদিকের দৃশ্য সত্যিই নয়নাভিরাম। ঘন জঙ্গল আর ছবির মত আদিবাসীদের টোলা গুলোর মোহিনী রূপ আপনার এই আদিম প্রকৃতির কাছে আসার কষ্টকে বহুলাংশেই লাঘব করে দেবে। বর্ষায় এলে কালি ঝরনা ও গড়ুরঝরনা দুটো দেখার জন্য হাতে সময় রাখবেন।সতর্ক করে দেওয়ার জন্য বলতে পারি, বর্ষা ভিন্ন ঝরনাগুলির করুণ রূপ আপনাকে হতাশ করতে পারে। আর যদি নৃতত্বে আগ্রহ থাকে, ঘুরে আসতে পারেন আদিবাসী গ্রাম বা টোলা গুলোতে। তাঁদের সহজ সরল কিন্তু বলিষ্ঠ জীবন সংগ্রাম আকর্ষনের কেন্দ্র হতেই পারে।অযোধ্যার বহু অচেনা জনপদ আজ পর্যটকদের কাছে আকর্ষনীয় হয়ে উঠছে, উসুলডুংরি তাদের মধ্যে অন্যতম। ধীরে ধীরে দর্শনীয় স্থান হিসেবে উসুলডুংরির উত্তরণ, প্রাকৃতিক সূর্যোদয়ের মত এখানকার জনজীবনেরও ভাগ্যোদয় হবে, এ আশা করতেই পারি।।ছবিঋণ — অন্তর্জাল

Published by moon DJ studio

https://wbsfda.org/

Leave a comment

Design a site like this with WordPress.com
Get started