|| চির অদম্য শিবাজী ||▪ কলমে : Debasish Sengupta ১৯ ফেব্রুয়ারী ২০১৭ রাতের দিকে শিবাজী ব্যানার্জী চলে গিয়েছিলেন না ফেরার দেশে। তার ঠিক ৪ বছর ৪ মাস ২৫ দিনের মাথায় গতকাল তিনি মোহনবাগান ক্লাব দ্বারা নির্বাচিত হয়েছেন মরণোত্তর মোহনবাগান রত্ন (২০২১) হিসেবে। ১৯ ফেব্রুয়ারী ২০১৭ তারিখে হৃদরোগের পেনাল্টি শট বাঁচাতে পারেননি বহু পেনাল্টি বাঁচানোর নায়ক। সত্তরের এক গোলকিপিং আইকন অকালে জীবন মাঠের বাইরে চলে গিয়েছিলেন সেদিন। গুগল ঘেঁটে এই প্রথম ছবিটা পেয়ে গিয়েছিলাম তার ২ দিন পরে, ২০১৭র ২১ ফেব্রুয়ারী তারিখে।সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে গিয়েছিলাম প্রায় ভুলে যাওয়া, চাপা পড়া একটা ট্রেন জার্নির স্মৃতিও।এপ্রিল-মে ১৯৮০। রাণীগঞ্জের ব্যাঙ্কের চাকরী থেকে ২ সপ্তাহের ছুটি নিয়ে (তখন ২ সপ্তাহের ছুটি পাওয়া যেত ব্যাঙ্কে, এখন রূপকথা যদিও) এক বাইশ বছরের ফুটবল পাগল ফেডারেশন কাপ দেখতে পৌঁছে যায় বাড়িতে। সিজন টিকিট জুটে গেল (তখন জুটে যেত, চেষ্টা করলে)।৩টে গ্রুপ লীগ ম্যাচই জিতল মোহনবাগান ইডেনে, পাগলটার চোখের সামনে।সেমিফাইনাল পড়ল মহমেডানের বিরুদ্ধে।সেবার বোধহয় আগের কুড়ি বছরের মধ্যে সেরা টিম মহমেডানের (ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়-সন্তোষ বসু-চিন্ময় চ্যাটার্জী-শ্যামল ঘোষ-রমেন ভট্টাচার্য-প্রশান্ত ব্যানার্জী-সুরজিত সেনগুপ্ত-আকবর-সাবির আলি-ডেভিড উইলিয়ামসন সমেত)। ৫ মে ১৯৮০, সোমবার, ১ম লেগে ম্যাচ ড্র। ১-১।গৌতম সরকার ও আকবর গোল করেছিলেন মোহনবাগান আর মহমেডানের হয়ে।অন্য দিকে পাঞ্জাব পুলিসের বিরুদ্ধে ডাবল লেগ সেমিফাইনাল ৩-০ গোলে জিতে ফাইনালে পৌঁছে গিয়েছিল ইস্টবেঙ্গল।এমন সময় জরুরী একটা কাজের ডাকে ছেলেটাকে বহরমপুর (তার মামাবাড়ি, যেখানে কেটেছিল জুলাই ১৯৭৪ থেকে ডিসেম্বর ১৯৭৭ তার “রসায়নে সাম্মানিক” স্নাতক হওয়ার কৃষ্ণনাথ কলেজের জীবন) যেতে হল সোমবার, ৫ মে ১৯৮০ তারিখেই, রাতে। পরের দিন ৬ মে ১৯৮০, মঙ্গলবার, মোহনবাগান বনাম মহমেডান ২য় লেগ ড্র অবস্থায় শেষ হবার দশ পনেরো মিনিট আগে ঝড়জলে পরিত্যক্ত হল ০-০ অবস্থায়। ৭ মে ১৯৮০, বুধবার তারিখে রিপ্লে পড়ল সকাল ৮টায় (কেন না ফাইনালটা যে হতেই হবে বৃহস্পতিবার, ৮ মে ১৯৮০ তারিখে)।কাকতালীয় হলেও সত্যি এটাই যে ছেলেটার বহরমপুর থেকে ফেরা ঠিক ছিল ঐদিন, মানে ৭ মে ১৯৮০ তারিখে।কাকভোরের ট্রেনে।ফিরছিলও সে নির্দিষ্ট নির্ঘন্ট মেনে। তার সাথে ছিল শুধু একটা ছোট্ট পকেট ট্রানজিস্টর। রাণাঘাটে লেট ট্রেন দাঁড়ালো প্রায় ৩০ মিনিট।অজানা কারণে।তখনই ম্যাচ শুরু। জানলার বাইরে ট্রানজিস্টর ধরে তার রিলে শোনা শুরু।ট্রেন চললে শোনা যায়না প্রায় কিছুই।এক একটা স্টেশনে দাঁড়ালে স্পষ্টভাবে শোনা।যারা জানেন, তারা জানেন। এইভাবে ৭০ মিনিটের খেলা ১-১।কে আগে গোল দিয়েছিল, তার ঠিক মনে নেই। মিহির বসু আর আকবর ছিলেন গোলদাতা, এটা ঠিকঠাক মনে আছে।আর প্রতাপ ঘোষ ছিলেন মোহনবাগান গোলে। এটাও ঠিক মনে আছে।অতিরিক্ত ১৮ মিনিটও কেটে গেল। থামতে থামতে গরুর গাড়ীর গতি নিয়ে ট্রেন এল নৈহাটির কাছাকাছি। প্রতাপ ঘোষকে উঠিয়ে নামানো হল (কে জানত টিমকে নবজীবন দেবে কোচ অরুণ ঘোষের এই একটা সিদ্ধান্তই) ছবির গোলকিপারকে। আরও ২মিনিট কেটে গেল।খেলা ড্র। শেষ দুদিনে ১৫ ঘন্টার মধ্যে ১৬০ মিনিট খেলে (সেই প্রথম) টাইব্রেকারে নামল দুটো দল।কলকাতা ময়দানে সকালে খেলাও সেই প্রথম।সেই শেষও।তারপরের গল্প সবাই জানেন। ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায় কি করে আর আমার স্বপ্নের গোলকিপারকে টাইব্রেকারে হারাবেন? আরো অনেক টাইব্রেকারের মত এটাও জিতে নিয়ে সেদিন মোহনবাগানকে ফাইনালে তোলেন আমার হিরো। মোহনবাগানের হয়ে সেই সকালে চাপের টাইব্রেকারে গোল করেছিলেন সুব্রত ভট্টাচার্য, গৌতম সরকার, মানস ভট্টাচার্য আর বিদেশ বসু।মহমেডানের হয়ে গোল করেছিলেন চিন্ময় চ্যাটার্জী আর ডেনিস উইলিয়ামসন।ব্যারাকপুরে ট্রেন দাঁড়ানো অবস্থায় ম্যাচ শেষ হয়েছিল, মনে আছে।সেই ম্যাচের এই ছবিটা খুঁজে পেতেই চাপা পড়া সেদিনের ট্রেন জার্নির স্মৃতিটা দু হাত মেলে সামনে এল। যেমন আমার প্রিয় শেষ দুর্গপ্রহরী আসতেন পেনাল্টি শুটারদের সামনে।ভারতীয় ফুটবলে পেনাল্টি আর টাইব্রেকার শব্দ দু’টো যতদিন থাকবে, ততদিন থাকবে শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় নামটাও।তা সে যতই হৃদরোগের শেষ পেনাল্টিটায় গোল খেয়ে যেতে বাধ্য হয়ে থাকুন তিনি ১৯ ফেব্রুয়ারী ২০১৭-য়।স্মৃতির গোলপোস্টের নীচে আপনাকে স্বাগত, না থেকেও থেকে যাবার সাড়েচার বছর পরে।আপনার রেকর্ড টেকর্ড আর গোলকিপিংয়ের টেকনিক নিয়ে নাড়াচাড়া করবে ইতিহাস।”গুণমুগ্ধ ক্যাপটিভ”দের সে দায় না ছিল, না আছে, না থাকবে।বছর দেড়েক আগে আমার একটা শেয়ারড পোস্টে Chiranjeev-দা তার মন্তব্যে জানিয়েছিলেন “কী নিষ্ঠা ছিল শিবাজীর।১৯৮৮তে সিওল অলিম্পিক্স কভার করতে যাওয়ার আগে টাইপ শিখল। গণশক্তির Editor অনিল বিশ্বাস শুনে অবাক।” পেনাল্টি মারিয়েরা ভয় পেত তাকে।এবং শুধু পেনাল্টি বাঁচানো নয়, শুধু গোল বাঁচানো নয়, শুধু ফুটবলে দলকে আগলানো নয়, পৃথিবীর যে কোন কাজে শিবাজীদার নিষ্ঠা ছিল প্রথম শ্রেণীর এবং অবশ্যই শিক্ষণীয়।গতকাল ছিল শিবাজীদার মরণোত্তর মোহনবাগান রত্ন (২০২১) ঘোষিত হবার দিন। যেখানে আছেন, ভাল থাকবেন গোলকিপিংএর সুদর্শন বস্।🙏🙏(১ম ও ২য় ছবি – গুগল / ৩য় ছবি – Mohun Bagan E-Library-র দেওয়াল থেকে)#ম্যাচরেফারী